টেস্ট ক্রিকেটের সর্বনিম্ন ২৬ রানের আগে অল আউট হওয়ার চোখ রাঙানি দিচ্ছিল। নিজেদের ৪৩ তো তখন অনেক দূর। ব্যাটসম্যানদের আসা-যাওয়ার মিছিলে মনে হচ্ছিল ডারবানে চলছে ‘হরর শো’। ঢাকার রাস্তায় জ্যামে বসে ক্রিকইনফো লাইভ একবার করে রিফ্রেশ দেওয়া মানেই যেন, একজন করে ব্যাটসম্যান সাজঘরে! শেষমেশ ৫৩ রানে শেষ বাংলাদেশের ইনিংস। ২২ গজে বাংলাদেশ এতটা খারাপ সময় শেষ কবে কাটিয়েছিল মনে নেই। তবে টেস্ট ক্রিকেটে নিজেদের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন রানে অলআউটের লজ্জা পেয়ে গেছে মুমিনুল হকের দল। সঙ্গে ডারবানের কিংসমিডে ভারতকে সরিয়ে বাংলাদেশের ৫৩ রানই এখন সবার তলানিতে।
২২০ রানের বিশাল পরাজয়ে শেষ ডারবান টেস্ট। কোন ভুলে এত বড় হার বাংলাদেশের? উত্তর খুঁজেছে রাইজিংবিডি- ১) টস সিদ্ধান্ত: ডারবানে টস জিতেছিল বাংলাদেশ। টেস্ট ম্যাচে অতি আত্মবিশ্বাসী না হলে এবং উইকেট পুরোপুরি নখদর্পর্ণে না থাকলে টস জিতে বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া স্রেফ ‘আত্মাহুতি’ দেওয়ার সামিল। কারণ চতুর্থ ইনিংসে ব্যাটিং করার ঝুঁকি তখন থেকে যায়। টেস্ট ক্রিকেটে ২২ বছর কাটিয়ে দিলেও বাংলাদেশ এখনও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। নিজেদের শক্তি ও সামর্থ্যে আত্মবিশ্বাসী থাকলেও প্রতিপক্ষ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে সেই ধারণা করতে পারেনি বলেই মনে হচ্ছে।
পাশাপাশি একটি বিষয় বিবেচনায় আনতেই হবে, প্রথমদিন ম্যাচ শেষে কোচ রাসেল ডমিঙ্গো এসে বলেছিলেন, নতুন বলে নতুন উইকেটে ব্যাটিংয়ে আত্মবিশ্বাসী নয় বাংলাদেশ। এজন্য দক্ষিণ আফ্রিকাকে ব্যাটিংয়ে পাঠিয়েছিল। ব্যাটিং পেয়ে স্বাগতিকরা অবাকই হয়েছিলেন। ২) একাদশ সাজাতে পরিকল্পনার ঘাটতি: উইকেটে টার্ন হবে। তাই দুই পেসারের সঙ্গে দুই স্পিনার নিয়ে নেমেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। অথচ বাংলাদেশ মিরাজকে নিয়েই সাজায় একাদশ। সঙ্গে ছিলেন তিন পেসার- তাসকিন, ইবাদত ও খালেদ। পেস ত্রয়ী খারাপ করেননি মোটেও। দুই ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকাকে অলআউট করতে বড় ভূমিকা রেখেছেন।
সঙ্গে মিরাজও ছিলেন দারুণ। কিন্তু আরেক স্পিনার বড় পার্থক্য গড়ে দিত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশ বাড়তি ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলতে নামায় এই কম্বিনেশন ঠিক করেছিল। অথচ দক্ষিণ আফ্রিকা দুই স্পিনার কেশব মহারাজ ও সাইমন হার্মারকে খেলিয়েছে নির্দ্বিধায়। দ্বিতীয় ইনিংসে তাদের ১৯ ওভারেই শেষ বাংলাদেশের ইনিংস। তৃতীয় বোলারকে কাজেই লাগেনি। ৩) ব্যাটসম্যানদের বাজে শট নির্বাচন: দুই ইনিংসে একাধিক ব্যাটসম্যানের বাজে শট নির্বাচন কাল হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশের জন্য। প্রথম ইনিংসে জয় ছিলেন ধ্রুপদী। ইনিংসে ইনিংসে তার মনোযোগ ঠিক থাকেনি। সাদমান দুই ইনিংসেই ফ্লপ। নিজের উইকেট উপহার দিয়েছেন। দুই ভরসার নাম মুশফিক ও মুমিনুল দুই ইনিংসেই যাচ্ছেতাই শটে আউট হয়েছেন।
দেখে মনে হয়েছে, স্পিন তারা খেলতেই পারেন না। অথচ ঘরের মাঠে স্পিনে তারা কতটা সাবলীল, সেটা রেকর্ড দেখলেই বোঝা যায়। শান্ত প্রথম ইনিংসে বাজে আউট হলেও দ্বিতীয় ইনিংসে তার করার খুব একটা কিছু ছিল না। লিটন দ্বিতীয় ইনিংসে আলগা শট খেলে ফেরেন সাজঘরে। ইয়াসির প্রথম ইনিংসে রান আউট হয়েছেন নিজের ভুলে। দ্বিতীয় ইনিংসে মহারাজকে উইকেট উপহার দিয়েছেন। সব মিলিয়ে জয়ের প্রথম ইনিংস বাদে ডারবান টেস্টে পুরোটা সময় ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং ছিল তালগোল পাকানো। বাজে শট নির্বাচনে প্রত্যেকেই ছিলেন আসা-যাওয়ার মিছিলে। ব্যাটসম্যানদের দায় স্বীকার করে নিয়েছেন মুমিনুল, ‘আমার মনে হয় বিদেশে এসে স্পিনারদের উইকেট দেওয়া বিরাট বড় ক্রাইম।
আমার মনে হয় বিদেশে এসে আপনি স্পিনারদের উইকেট দিতে পারবেন না। এই কারণে দায়টা আমারই বেশি। বিদেশে এসে স্পিনারদের কোনোভাবেই উইকেট দেওয়া যাবে না। অবশ্যই এটা ব্যটিং ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই না।’ ৪) বড় পার্থক্য গড়ে দেয় লোয়ার অর্ডার: প্রথম ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকাকে পুরোপুরি চাপে রেখেছিল বাংলাদেশ। প্রোটিয়ারা ৮ উইকেট হারায় ২৯৮ রানে। সেখান থেকে লোয়ার অর্ডারে শেষ ২ উইকেটে ৬৯ রান যোগ করে স্বাগতিকরা। এই সময়ে আলগা বোলিংয়ে কোনো চাপ তৈরি করতে পারেননি মিরাজ, খালেদ, ইবাদতরা। ফলে অতি সহজেই রান নেন ব্যাটসম্যানরা। অন্যদিকে বাংলাদেশের ইনিংসে শেষ ২ উইকেটে পুঁজি মাত্র ৩১ রান। সেটাও পরীক্ষিত ব্যাটসম্যান জয় থাকায় হয়েছে। নয়তো সেই রানটাও হতো না। বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে ৬৯ রানে পিছিয়ে ছিল। যা পরাজয়ের অন্যতম বড় কারণ।
লোয়ার অর্ডার ব্যাটিং নিয়ে মুমিনুল বলেছেন, ‘আগে খারাপ ছিল, কিন্তু এখন উন্নতি হয়েছে অনেক। লোয়ার অর্ডাররা এখন ব্যাট করতে চায়। একসঙ্গে উন্নতি হবে না, আস্তে আস্তে হচ্ছে। তাসকিন জিম্বাবুয়েতে রিয়াদ ভাইয়ের সঙ্গে ভালো জুটি গড়েছে। নিউ জিল্যান্ডেও ওরা ভালো করেছে। তো উন্নতি হচ্ছে আগের চেয়ে অনেক ‘ ৫) রিভিউয়ের বাজে ব্যবহার: দ্বিতীয় ইনিংসের ঘটনা। পেসার খালেদ আহমেদের ভেতরে ঢোকানো বল মিস করেছিলেন কিগান পিটারসেন। বাংলাদেশের আবেদনে সাড়া দেননি আম্পায়ার। অধিনায়ক মুমিনুল আত্মবিশ্বাস রাখতে পারেননি খালেদের ওপর। কিন্তু টিভি রিপ্লেতে দেখা যায় বল ঠিকই সঠিক লাইনে পিচ করে উইকেটে আঘাত করছিল। চতুর্থ দিন মধ্যাহ্ন বিরতির পর তাসকিন ফেরান এলগারকে। কিন্তু ডানহাতি পেসারের আবেদনে সাড়া দেননি হোল্ডস্টক।
রিভিউ নেন তাসকিন। পেয়ে যান সাফল্য। রিভিউয়ের এমন দোলাচল ছিল পুরো ম্যাচ জুড়ে। কখনো বাংলাদেশের অধিনায়ক সাহস দেখিয়েছেন। কখনো পারেননি। কখনো সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের পক্ষে এসেছে। কখনো বিপক্ষে গেছে। ডারবানে অনফিল্ড দুই আম্পায়ারের এরকম ‘ইনকন্সিসটেন্স আম্পায়ারিংয়ে’ হতাশ বাংলাদেশের অধিনায়ক। সঙ্গে নিরপেক্ষ আম্পায়ারিংয়ের জোর দাবিও করে রাখলেন তিনি, ‘আম্পায়ারিং আমাদের হাতে নেই। এখন আইসিসির উচিত নিরপেক্ষ আম্পায়ার দিয়ে দেওয়া। আগে কোভিডের কারণে সুযোগ-সুবিধা ছিল না, এখন তো সেই অবস্থা ওভাবে নেই। নয়তো এরকম তো অনেক সিরিজেও হয়েছে এবং এই সিরিজেও হলো যে আম্পায়াররা ওদের দেশের পক্ষে সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকে।’ দুই দলের পরবর্তী টেস্ট জোহানেসবার্গে ৭ এপ্রিল। নিজেদের ভুলগুলো শুধরে বাংলাদেশ সিরিজে সমতা আনতে পারে কি না সেটাই দেখার।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।